রাতের অন্ধকার এবং নীরবতা ফুঁড়ে চমকে উঠি আমি। নিদ্রামগ্ন চোখ আলোহীন পরিবেশে অভ্যস্ত হতে সামান্য সময় নেয়।
কী সব উড়নচণ্ডী স্বপ্ন দেখে ঘুমটা ভেঙে যায়। বেশ কিছুক্ষণ নিজেকে খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করলাম। কেন যেন ঘুম ভাঙলেই কাঁচা স্বপ্নের স্মৃতিগুলো নাতিশীতোষ্ণ হয়ে স্বচ্ছ কল্পনাকে এলোমেলো করে দেয়। নিজেকে ধাতস্থ করতে প্রক্ষালন কক্ষে ঢুকলাম। অনেকক্ষণ শীতল পানির ঝাপটায় চেহারা ভেজালাম। যখন মনে হলো এবার আমি নিশ্চিন্ত, ফিরে এসে বিছানার কিনারায় বসলাম। স্ত্রী জেগে থেকেও রাজত্ব করেন, ঘুমেও তাই! পুরো বিছানায় তার রাজত্ব।
আমি শুধু এক কোনায় ক্ষুদ্র দ্বীপের মতো সামান্য স্থান পাই। বিছানার কিনারায় বসে থেকে ভাবি পঁয়ত্রিশ বছরের সংসার, ভালোবাসায় কোনো কৃত্রিমতা নেই। পরস্পরের ভালোবাসায় কোনো সমস্যাও নেই। তবু আমি এমন স্বপ্ন কেন দেখলাম! মনে মনে ভাবছিলাম এই পরিপক্ব বয়সে এসে বুঝি প্রেমের প্রথম পাপ করলাম।
চখাচখির জোড়া নিয়ে জীবন কাটানো আমরা। আমার নিজের স্ত্রীর বাইরে, সংসারের বাইরে যার কোন চিন্তার দৌড় নেই। সেই আমি কেন এই প্রৌঢ় বয়সে ষোড়শীর হাত ধরে নিকোনো উঠোনে হাঁটব। তার দুচোখ দেখে কেন ভাবব ‘আহা কী স্বপ্নময় স্নিগ্ধ চাঁদ চোখ, যেন তার ভুরুর পাহারায় নিশ্চিন্তে প্রেমের আনন্দে চমকাচ্ছে। শরতের চাঁদে অবগাহন করব।
একটা চমৎকার সবুজ পরিবেশে পার্কের মাঝখানে বসে আছে সে। যেন বাতাস তার অদৃশ্য স্পর্শে ঝিরিঝিরি কাঁপন তুলে মেয়েটাকে ছুঁয়ে যেতে চায় কিংবা ছুঁয়ে যায় যেন সোহাগের স্পর্শ। শিহরণে চমকে ওঠা মেয়েটি একবার একদিকে তো আরেকবার অন্যদিকে তাকায়, যেন বাতাসের কাঁপনে কলাপাতা দোল।
নিজের মাথাকে তীব্র গতিতে ঝাঁকানি দিই, যেন মাথা থেকে অদ্ভুত স্বপ্নের রেশ ছিটকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু আমার স্বপ্ন যেন আজ বেহায়া নাছোড়বান্দা, পাথর হয়ে বসে আছে চিন্তার গভীরে। অসভ্য স্বপ্নটা যে নুড়ি নয় তা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। হিসাবটা সহজ, বাতাস নুড়িকে নাড়াতে পারে, প্রস্তর খণ্ডকে দোলাতেও পারে না।
আর আমি চেষ্টা করছি চিন্তার গহ্বরে বাসা বাঁধা স্বপ্নের প্রস্তরখণ্ড যেন উড়িয়ে নিয়ে যায়। দুষ্ট স্বপ্নের উই তাড়াতে আমার সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে ঝাঁকি দিয়ে প্রিয়তমা স্ত্রীকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলি। গভীর ঘুম থেকে হঠাৎ জাগানোর কারণে প্রথমে হুড়মুড়িয়ে অজানা ভাষায় কী যেন বকতে বকতে বিছানায়
উঠে বসে।
এলো চুল আর এলোমেলো বসনে হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে যায়। হয়তো তার মায়ার জিনটা জেগে ওঠে। সে নিশ্চুপ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। কপালের সামনে থেকে গুচ্ছ চুল ঝুলে থেকে তার চেহারায় এক ধরনের রহস্যময়তা সৃষ্টি করে। তার ঝুলে থাকা চুলের ফাঁক দিয়ে এক দৃষ্টিতে সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমি অভিভূত হয়ে যাই। কখনো কখনো মেয়েদের বাগ্মিতার চাইতে নীরবতাকে অনিন্দ্য সুন্দর দেখায়। আমার দেখা স্বপ্নটা এই মুহূর্তে ওর সৌন্দর্যের নিকট প্রচণ্ড হোঁচট খায়। আমি বাস্তবে ফিরে আসতে শুরু করি। স্ত্রী তার আবেগি চাহনি থেকে বাস্তবে এসে জানতে চায় ‘কী হয়েছে তোমার?’ বললাম ‘সুখ স্বপ্নের আদলে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম এখন যা কেটে গেছে। আমার কথার কোনো অর্থই খুঁজে পায় না সে। বিরক্ত হয়ে ‘ধুত্তুরি’ বলে পাশ ফিরে আবার শুয়ে পড়ে। স্ত্রীর বিরক্তি দেখে ভাবি আমি কি অপরাধী নাকি উদ্ন্তম প্রেমিক।
ভাবতে থাকি কতটা সুন্দর এবং সাধারণভাবে স্ত্রীর মূল্যবান সময়কে অপহরণ করে নিয়ে নিজেকে নষ্ট স্বপ্ন থেকে বাঁচাতে পেরেছি। নীরবে শব্দহীন হৃদয় স্ত্রীর নিকট ক্ষমা চেয়ে নেই এবং কৃতজ্ঞ হই। হয়তো তার ঘুম না ভাঙলে আমি তখনো স্বাপ্নিক পরকীয়ায় ব্যস্ত থাকতাম। তার নিশ্চিন্ত ঘুম আমাকেও ঘুমের ঘোরে নিয়ে যায়।
ঘোরের মধ্যেই আবারও স্বপ্নের দরজা খুলে যায়। গভীর রাতে আমাদের রুমের আলো দেখে বাবা এসে হাজির হন। জানতে চান এখনও জেগে আছি কেন? বললাম, কেমন অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম, এরপর থেকে আর ঘুম আসছে না। বাবা আমাকে বকতে শুরু করলেন ‘তোর কি জীবনেও কাণ্ডজ্ঞান হবে না। মেয়েটা সারাদিন অফিসে খাটা খাটুনি করে, আবার বাসায় এসে সবার অন্নের জোগান দেয়। রাতে একটু বিশ্রাম করবে তাও তোর জ্বালায় পারে না। স্বপ্ন দেখেছিস ভালো কথা তো বউমাকে কষ্ট দিচ্ছিস কেন।
যা শুয়ে পড়ো।শেষের কথাগুলো বাবা এত জোরে চিৎকার এবং ধমক দিয়ে বললেন যে আমি চমকে উঠলাম, সম্বিত ফিরে দেখি কোথায় বাবা, বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন সেই কবে। বাবা আমার স্ত্রীকে খুবই আদর করতেন। হয়তো এটা তারই প্রচ্ছায়া। তিনি আমার স্ত্রীকে কন্যার বাইরে কখনো কিছু ভাবতেই পারেননি।
একটা স্বপ্ন আমাকে বিভ্রান্ত করে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। একটা স্বপ্নে কেন আমি এমন হয়ে গিয়েছিলাম। স্বপ্নেই কেন বাবা। বাবার বাস্তব এবং চিরচেনা রূপ আমাকে কাঁদিয়ে ছাড়ল। আবার ভাবি তা হলে তরুণী বা কেন! আমি তো অবচেতন মনেও কখনো কোনো তরুণীকে কল্পনা করিনি, তবে কেন!
স্বপ্ন এবং স্বপ্নের ভেতরের স্বপ্নের কথা মনে পড়তেই বাবার কথা বেমালুম ভুলে যাই।
স্বপ্নের সমাধান হলেও এর ফ্রয়েডীয় ব্যাখ্যাটাও যে জানা দরকার। সবকিছুর সমাধান হলেও তবু ভেতরে এক ধরনের হারানো অনুভূতি থেকে যায়। মনটা জানতে চায়, ‘এত সুন্দর তুমি হলে কী করে! নাইবা এলে বাহু মাঝে, নাইবা হলে আমার স্বপ্নের দুরন্ত নায়িকা, অন্তত তোমার নামটা তো বলে যেতে পারতে!