টানা বর্ষণ, উজানের ঢলের পানি চাপ
দুদিনের টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে তিস্তার নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। পানির চাপ সামাল দিতে ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। পানি বিপদসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হওয়ায় নদীপারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
উত্তরাঞ্চলে বিভিন্ন স্থানে শুক্রবার সারা দিন অব্যাহত ছিল বৃষ্টিপাত। দিনভর টানা মাঝারি ধরনের বর্ষণ হয়েছে। এর মধ্যে শুধু রংপুরেই গত ৪৮ ঘণ্টায় ২৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদফতর।
এদিকে হালকা থেকে মাঝারি, আবার কোথাও কোথাও ভারী বর্ষণে তিন দিন ধরে রংপুর অঞ্চলের নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। রংপুর বিভাগের তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরদিকে দুধকুমার নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে। এসব নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এ ছাড়া দুই দিনের টানা বৃষ্টিতে দিনাজপুর জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া পুনর্ভবা, আত্রাই আর ইছামতী-এই প্রধান তিনটি নদীর পানি বিপদসীমার অনেকটা কাছাকাছি রয়েছে।
হঠাৎ টানা বৃষ্টিতে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ফলে বসতবাড়ি ও রাস্তাঘাট ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। সেই সঙ্গে ফসলি জমিতে পানি ওঠায় নষ্ট হচ্ছে আগাম শীতকালীন শাকসবজি ও বীজতলাসহ বিভিন্ন ফসল।
আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, শুক্রবার ও শনিবার দুই দিন পর্যন্ত রংপুর বিভাগ ও তৎসংলগ্ন উজানে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের প্রবণতা আছে। এর ফলে তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি সমতল আগামী দুই দিন পর্যন্ত দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে এবং পরবর্তী এক দিন পর্যন্ত নদীগুলোর পানি সমতল স্থিতিশীল থাকতে পারে। আগামী দুই দিন পর্যন্ত লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও কুড়িগ্রাম জেলার তিস্তা নদীর পানি সমতল সতর্কসীমায় প্রবাহিত হতে পারে। এসব জেলার নদী তীরবর্তী চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে। অপরদিকে আগামী তিন দিন পর্যন্ত কুড়িগ্রাম জেলার ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি সমতল বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে।
অন্যদিকে রংপুর বিভাগের ব্রহ্মপুত্র নদ ও তার ভাটিতে যমুনা নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে এবং বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি সমতল স্থিতিশীল থাকতে পারে এবং পরবর্তী চার দিন পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) রংপুরের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে সকাল ৯টায় পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫১ দশমিক ৭৬ সেন্টিমিটার। যা (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার) বিপদসীমার দশমিক ৩৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সকাল ৬টায় একই পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়।
এদিন সকাল ৯টায় তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ২৮ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। যা (স্বাভাবিক ২৯ দশমিক ৩১ সেন্টিমিটার) বিপদসীমার দশমিক ৫৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে সকাল ৬টায় বিপদসীমার দশমিক ৬১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়।
এ ছাড়াও সকাল ৯টার দিকে কুড়িগ্রামের ব্রক্ষ্মপুত্র নদের চিলমারী পয়েন্টে ২০ দশমিক শূন্য ৪ সেন্টিমিটার (স্বাভাবিক ২৩ দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার), দুধকুমার নদের পাটেশ্বরী পয়েন্টে ২৬ দশমিক ৬৪ সেন্টিমিটার (স্বাভাবিক ২৯ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার), ধরলা নদীর কুড়িগ্রাম পয়েন্টে ২২ দশমিক ৯০ সেন্টিমিটার (স্বাভাবিক ২৬ দশমিক ০৫ সেন্টিমিটার), গাইবান্ধার যমুনা নদীর ফুলছড়ি পয়েন্টে ১৫ দশমিক ২৬ সেন্টিমিটার (স্বাভাবিক ১৯ দশমিক ৩৫ সেন্টিমিটার), ঘাঘট নদের গাইবান্ধা পয়েন্টে ১৭ দশমিক ৩৫ সেন্টিমিটার (স্বাভাবিক ২১ দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার) পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে। সূত্র বলছে, রংপুর বিভাগের কোনো নদ-নদীতে বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে না।
প্রতিদিনের বৃষ্টিপাত আর উজানের ঢলে পানি বৃদ্ধির ফলে রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার সব নদ-নদীর পানির পাশাপাশি বিলের পানি বৃদ্ধিও অব্যাহত আছে। এতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় বসতবাড়ি ও রাস্তাঘাট ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। সেই সঙ্গে ফসলি জমিতে পানি ওঠায় নষ্ট হচ্ছে আগাম শীতকালীন শাকসবজি ও বীজতলাসহ বিভিন্ন ফসল।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া শাখার উপ-প্রকৌশলী মোহাম্মদ রাশেদীন বলেন, অব্যাহত বৃষ্টিপাতের কারণে তিস্তার পানি বাড়তে শুরু করেছে। পানির চাপ সামলাতে তিস্তার ৪৪ জলকপাট খোলা রাখা হয়েছে।
এদিকে তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানি বলেন, অসময়ের বন্যা ও ভাঙনে প্রতিবছর ১ লাখ কোটি টাকার সম্পদ তিস্তার গর্ভে চলে যায়। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য নদী খনন, সংরক্ষণ ও তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা ছাড়া বিকল্প নেই।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ আবহাওয়াবিদ মো. মোস্তাফিজার রহমান জানান, গত ৪৮ ঘণ্টায় রংপুর জেলায় ২৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। শুক্রবার রংপুর বিভাগসহ দেশের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের ভারী বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হয়।
এদিকে দুই দিনের টানা বৃষ্টিতে দিনাজপুর জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া পুনর্ভবা, আত্রাই আর ইছামতী-এই প্রধান তিনটি নদীর পানি বিপদসীমার অনেকটা কাছাকাছি রয়েছে। এতে নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চলগুলো তলিয়ে না গেলেও শুক্রবার সন্ধ্যার পর নদীগুলোর পানি কমা কথা বলে জানায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্তা। আর গত ২৪ ঘণ্টায় পুরো জেলায় বৃষ্টিপাত ১২০ দশমিক ২০ মিলিমিটার রেকর্ড করা হয়েছে জানায় দিনাজপুর আবহাওয়া অফিস।
সরেজমিন শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে শহরঘেঁষা পুনর্ভবা নদীর মাহুতপাড়া অংশে গিয়ে দেখা গেছে, দুই দিন আগে নদীর পানি ব্লকের নিচে অবস্থান করছিল আর আজ পানি নদীর সমতল ছুঁইছুঁই করছে। সারা দিন বৃষ্টি হলে সমতলের নিম্নাঞ্চল এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন নদীর তীরবর্তী এলাকার মানুষরা। আর পানির স্রোতে নদীর তীরবর্তী এলাকায় ভাঙনও হতে দেখা গেছে বলে জানান স্থানীয়রা।
দিনাজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, দুই দিনের টানা বৃষ্টিতে দিনাজপুর জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রধান নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। শুক্রবার সকাল ৯টায় শহরের পাশঘেঁষা পুনর্ভবা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ৩০ দশমিক ৯৬ মিটার ওপর দিয়ে। পুনর্ভবা নদীর বিপদসীমা ৩৩ দশমিক ৫০০ মিটার। জেলার খানসামা উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে ৪৪ দশমিক ৮৫ মিটারের বিপরীতে ৪৩ দশমিক ৫৮ মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই নদীর পানি চিরিরবন্দররের ভূষিরবন্দর অংশে বিপদসীমা ৩৯ দশমিক ১৫ মিটারের বিপরীতে প্রবাহিত হচ্ছে ৩৬ দশমিক ৪৬ মিটারে। এ ছাড়াও ফুলবাড়ী উপজেলা পয়েন্টে ইছামতী বা ছোট যমুনা নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে ২৭ দশমিক ২৮ মিটার ওপর দিয়ে। যদিও এই নদীর বিপদসীমা হচ্ছে ২৯ দশমিক ৫০০ মিটার।
দিনাজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. সিদ্দিকুর জামান নয়ন মেঘনা টিভিকে জানান, শুক্রবার সকাল ৯টায় জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রধান তিনটি নদীর মধ্যে শহরঘেঁষা পুনর্ভবা ও খানসামা উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদীর পানি বিপদসীমার খুবই কাছাকাটি প্রবাহিত হতে দেখা গেছে।
এ ছাড়াও ফুলবাড়ী উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ইছামতী নদীর পানি বিপদসীমার কাছাকাছি রয়েছে। তবে শুক্রবার সন্ধ্যার পর বৃষ্টি কমে গিয়ে নদীগুলোর পানি হ্রাস পায় বলে জানান পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই কর্মকর্তা।
দিনাজপুর আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক তোফাজ্জল হোসেন শুক্রবার সময়ের আলোকে বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ১২০ দশমিক ২০ মিলিমিটার।
তিনি আরও জানান, আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত রংপুর বিভাগ ও তৎসংলগ্ন উজানে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের প্রবণতা রয়েছে, যা ৮৯ মিলিমিটার কম-বেশি হতে পারে। তবে পরবর্তী দুই দিন বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে আসতে পারে বলে জানান এই কর্মকর্তা।